“ভাই রে মানুষ নাই এ দেশে, এ দেশের সকল মেকি সকল ফাঁকি, যে যার মৌজে আপন রসে।” বলেছিলেন চারণকবি মুকুন্দ দাস। যা তিনি কবিতায় সীমাবদ্ধ না রেখে নিজেই সুর করে গেয়ে বাউল হিসেবেও খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তাও আবার প্রায় একশত বছর আগে, যা এখনো আমাদের মুখে মুখে ফিরছে। কারণ, তিনি নিরেট সত্য বলেছেন এবং আমাদের বিক্রমপুরেরই মানুষ।
আবার রবী ঠাকুর আমাদের যথেষ্ট দিয়েছেন। দিয়েছেন ভালোবাসার, ভাবের, রসের জগতেও অপার। যা আমরা জপ করি বটে কিন্তু তাঁর ‘বঙ্গমাতা’ কবিতা কি পাঠ করি। যেখানে তিনি তার সব দুঃখ সোজাসাপ্টা ব্যক্ত করেছেন এভাবে, “সাত কোটি সন্তানের হে মুগ্ধ জননী রেখেছো বাঙ্গালি করে – মানুষ কর নি।“ তারপরও কি আমরা বদলেছি?
হ্যা, ধনে ধান্যে পুষ্পে আমরা আরো ভরেছি। গরীবের রক্ত চোষে আর দুর্ণীতির আশ্রয় নিয়ে টাকার পাহাড় গড়েছি, চাণক্য বিদ্যাবুদ্ধিতে জ্যোতি ছড়িয়েছি, জ্ঞানেগরীমায় অন্যকে ঘায়েল করতে শিখেছি, পরোনিন্দা আর পরোচর্চায় খ্যাতি পেয়েছি, হিংসা বিদ্বেষ আর হানাহানিতে পারঙ্গম হয়েছি এবং আরো কত কি করেছি। কিন্তু মুকুন্দ দাস আর রবী ঠাকুরের দুঃখ ঘোচাতে পারিনি।
ঠিক আছে মানলাম, কর্ম নয় নিয়তিই যদি এই হয় তাহলে কি আর করা। তাই হয়তো এভাবেই চলছে এবং চলবে। তারপরও মানুষ হিসেবে পরিচয় দিলে অন্তত কিছুটাও মনুষত্ব কি অবশিষ্ট থাকবেনা? কারণ, মানুষের মত চেহারা হলেইতো আর মানুষ হয়না। মানুষ হতে হলে ন্যুনতম মানবিকতা এবং মানুষের মত আচরণটুকুতো থাকা চাই।
কিন্তু হায়, এই মানবিক বিপর্যয় আর মহাবিপদ কালেও বিবেকহীনতা, পরশ্রীকাতরতা, অসততা, মিথ্যাশ্রয়িতা, পাপাচারীতা, দস্যুতা, জ্ঞানের অসাড়তা, ন্যায়নীতিহীনতা এবং বিচারহীনতার মাত্রায় আমরা যেন একটুও ছাড় দিতে চাইনা। আর তা স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠে যখন আমরা –
একঃ অসৎ উপায়ে টাকা বানাই, দুর্নীতি করি, ত্রাণ সামগ্রী চুরি করি।
দুইঃ জিনিষপত্রের মজুতদারী করি, দাম বাড়াই, কৃত্তিম সংকট তৈরী করি।
তিনঃ খাবার আর জীবন রক্ষাকারী ঔষধে ভেজাল মিশাই।
চারঃ চুরি করি, চোরাচালানী ও নেশাদ্রব্য চালানীর সিন্ডিকেট গড়ি।
পাঁচঃ জনগনের টাকায় পড়াশুনা করে শপথ নিয়েও জনগনের বিপদে সেবা দিতে চাইনা।
ছয়ঃ জনগনের টাকায় বেতন-ভাতা নিয়ে জনগনের বিপদেও দায়িত্ব পালন করতে চাইনা। সাতঃ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং ধর্মীয় দায়িত্ব পালনে সৎ, সর্বজনীন ও ন্যায়পরায়ণ হতে পারিনা। আটঃ অন্যরা যখন খাবার পায়না তখনও নিজেদের স্বার্থ রক্ষার দাবী নিয়ে স্বোচ্চার থাকি।
নয়ঃ সংবাদ মাধ্যম চালাই কিন্তু সত্য প্রকাশে সাহসী এবং নির্ভীক হতে পারিনা।
দশঃ ব্যক্তিস্বাধীনতা এবং সহজলভ্যতার সুযোগ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক, ইউটিউব ইত্যাদিতে বিবেক ও কাণ্ডজ্ঞানহীনভাবে নিজের প্রচার, নিজে নিশ্চিত না হয়ে কিছু প্রচার বা অপপ্রচার, মিথ্যা প্রচার, মানুষের দুর্ভোগ নিয়ে কৌতুক প্রচার, অপ্রয়োজনীয় ও অশালীন বিষয় প্রচার ইত্যকার কি না প্রচার করি।
এবার নাহয় থামি। আর নয়, অন্তত এই বিষয়গুলোর সাথে আমরা কি যার যার অবস্থান থেকে মুক্ত আছি? বিবেক কী বলে? উত্তর কঠিন এবং অনেকেই আটকে যাবো। আর তাই যদি হয় তাহলে কি করে বলি মানব বিপর্যয়ের মত এমন বিপর্যয়ে কিংবা পরেও আমাদের মধ্যে কোন পরিবর্তন আসবে। অথচ গোটা বিশ্বে প্রকৃতি থেকে শুরু করে মানুষ আর পশুপাখি সবার মধ্যে পরিবর্তন আসা শুরু হয়ে গেছে।
দেশের ভিতরেই ঢাকার বাতাস হালকা ও পরিষ্কার হয়ে আসছে, কক্সবাজারে ডলফিনরা এসেই গেছে, কুয়াকাটায় ঝাঁকে ঝাঁকে লাল কাঁকড়ার বিচরণ আর গাছে গাছে পাখীরা আবার উড়াউড়ি শুরু করেছে। এভাবে সারা বিশ্বজুড়ে আরো কত পরিবর্তন আসবে যদিও আরো মানুষ মরবে, অর্থনীতি আরো ধ্বংশ হবে। তারপরও কি আমাদের মধ্যে কোন পরিবর্তন আসবেনা? আমরা কি মানুষ হবোনা?
(লেখক – পর্যটন ব্যক্তিত্ব)