সিলেট পুলিশ লাইনের পুকুরে স্কুলছাত্রের রহস্যজনক মৃত্যু

নিউজ ডেস্ক::  সিলেটে এক স্কুলছাত্রের মৃত্যু নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়েছে। শুরুতে পুলিশ লাইনের পুকুরে ডুবে মৃত্যু হয়েছে মনে হলেও অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে রোমহর্ষক ঘটনা। নগরীর দাড়িয়াপাড়ার বাসিন্দা রেদোয়ান আহমদ খালেদ মিয়ার ছেলে ও জিন্দাবাজারের মেরিট হোম স্কুলের ৫ম শ্রেণীর ছাত্র মাহমুদুল হাসান মাহি (১২) পানিতে ডুবে নয়, তাকে নির্যাতন করে পানিতে ফেলে দেয়া হয়। তার বন্ধুরা ঘটনা দেখে পানিতে নেমে খোঁজাখুঁজিও করে। কিন্তু উদ্ধার করতে না পেরে ঘটনা চেপে যায়। গত ২১ জুন বিকালে ঘটনাটি ঘটে। কিন্তু মাহির ৬ বন্ধু পানিতে ডুবে যাওয়ার বিষয়টি জানায়নি মাহির পরিবারকে। মাহির ব্যবহৃত জামাকাপড় নিয়ে তারা স্কুলের কাছে ফেলে রাখে। সেদিন মাহি ফিরে না আসায় দাড়িয়াপাড়া এলাকায় মাইকিং করে নিখোঁজ সংবাদ প্রচার করা হলেও বাড়ির আশপাশে থাকা সহপাঠীরা কোনো তথ্যই দেয়নি মাহির পরিবারকে।

ঘটনা রহস্যজনক মনে হলে অনুসন্ধানে নেমে খুঁজে বের করা হয় মাহির বন্ধু মিনারুলের পরিবারকে। প্রথমে মিনারুলের বাবা মিনারুলের সঙ্গে কথা বলতে দিতে চাননি। মিনারুলের কাছে বিষয়টি তুলতেই সে কিছু জানে না বলে জানায়। দীর্ঘক্ষণ কথা বলার পর সে ঘটনার কথা স্বীকার করে। মিনারুল সাংবাদিকদেরকে বলে, ‘আমরা সাত বন্ধু নগরীর রসময় স্কুল মাঠে ফুটবল খেলা শেষে পুলিশ লাইন পুকুরে গোসল করতে যাই। গোসল শেষে হঠাৎ তিন যুবক এসে সেখান থেকে আমাদের তাড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করে। ভয়ে সবাই দৌড় দিই। তিন যুবক মাহি ও আমাকে ধরে ফেলে। পুকুর পাড়ে আমাদের অনেক মারধর করা হয়। মারধরের একপর্যায়ে আমাকে লাথি দিলে আমি সরে যাই। মিনারুলকে ধাক্কা দিয়ে পানিতে ফেলে দেয় ওরা। এরপর মাহি পানিতে পড়ে ডুবে যায়। ওই যুবকরা দৌড়ে পালায়। তাদের নাম-পরিচয় না জানলেও চেহারা দেখলে চিনতে পারব। ওই সময় আমি চিৎকার করে পুলিশ লাইনের সবাইকে বলি- মাহিকে ওরা মারধর করে ধাক্কা দিয়ে পানিতে ফেলে পালিয়েছে। তাকে এখন পাওয়া যাচ্ছে না। পুলিশ লাইনের লোকসহ প্রায় ১৫-১৬ জন মিলে পুকুরে নেমে অনেক খোঁজাখুঁজি করে মাহিকে না পেয়ে বাসায় ফিরে আসি। এ ব্যাপারে আমরা আর কাউকে কিছু বলিনি।’

পরদিন শুক্রবার বেলা সাড়ে ১১টায় সিলেট জেলা পুলিশ লাইন পুকুর থেকে মাহির লাশ উদ্ধার করা হয়। লাশ ময়নাতদন্তের জন্য নেয়া হয় সিলেট এমএজি ওসমানী হাসপাতালের মর্গে। মাহির পরিবার অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে লিখিত আবেদন করে ময়নাতদন্ত না করিয়ে লাশ নিয়ে দাফন করে।

মিনারুল জানায়, তারা ৭ বন্ধু জাবেদ, কামরান, আল আমিন, শুভ ও মিনারুলের ভাই হাফিজুল ২১ জুন বৃহস্পতিবার বিকাল ৪টার দিকে নগরীর দাড়িয়াপাড়ার রসময় স্কুল মাঠে ফুটবল খেলা শেষে গোসল করতে যায়। যাওয়ার পর সেখানে ঘটে এমন ঘটনা। মিনারুল মিয়া ও হাফিজুল নগরীর জল্লারপাড়ের জাবেদ মিয়ার কলোনির ভাঙারি ব্যবসায়ী ইলু মিয়ার ছেলে, শুভ বাচ্চু মিয়ার কলোনিতে থাকে, দাড়িয়াপাড়ায় থাকে কামরান, জল্লার পাড় থাকে জাবেদ ও আরমান। মিনারুল ও জাবেদের বক্তব্যে অনেকটা মিল পাওয়া গেলেও শুভ ও হাফিজুলের বক্তব্যে কোনো মিল নেই।

জাবেদ জানায়, পুকুরে খোঁজাখুঁজি করে মাহিকে না পেয়ে ফেরার সময় তাদের বড় ভাই শুভ, হাফিজুল ও কামরান বলে বাঁচতে হলে মাহির কাপড়-চোপড় নিয়ে রসময় স্কুলের মাঠে ফেল। তাদের কথামতো মিনারুল মাহির ঘড়ি, জাবেদ জুতা ও আল আমিন গেঞ্জি নিয়ে রসময় স্কুলের মাঠে রাখে।’

শুভ প্রথমে অস্বীকার করলেও মিনারুল ও জাবেদের বরাত দিয়ে জিজ্ঞেস করলে সে বলে, ‘আমি ও হাফিজুল এক সঙ্গে গিয়েছিলাম। সবাই পুকুরে গোসল করার সময় মাহি এক পাশে বসে ছিল। হঠাৎ শুনি মাহি নেই। তারপরও পানিতে খোঁজাখুঁজি করে আর পাইনি। আমরা চলে আসি। মাহির কাপড়-চোপড় রসময় স্কুলে নেয়ার কথা আমি বলিনি- হাফিজুল, কামরান ও আল আমিন বলেছে।’ শুভ জানায়, ‘পুকুর পাড়ে দু’জন পুলিশ লাঠি দিয়ে আমাদের তাড়া করে। আমি এরচেয়ে বেশি কিছুই জানি না।’

হাফিজুল সবকিছু অস্বীকার করে বলে সে কিছুই জানে না। সে তার ভাই মিনারুলকে আনতে গিয়েছিল। শুভর বরাত দিয়ে জিজ্ঞেস করা হলে বলে, ‘আমি নই, শুভই মাহির কাপড়-চোপড় এনে রসময় স্কুলের মাঠে ফেলতে ছোট ভাইদের নির্দেশ দেয়।’

নিহত মাহির বাবা ও নগরীর দাড়িয়াপাড়া মেঘনা বি/১-এর বাসিন্দা রেদোয়ান আহমদ খালেদ বলেন, ‘প্রতিদিনের মতো বৃহস্পতিবারও খেলতে যায় মাহি। রাতে বাসায় না ফেরায় খুঁজতে বের হই। অনেক খোঁজাখুঁজি করে না পেয়ে রাত ২টায় কোতোয়ালি থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করতে যাই। পুলিশ নানা অজুহাত দেখিয়ে জিডি নেয়নি। পরদিন শুক্রবার সকালে আবার থানায় যাই তখনও জিডি নেয়নি পুলিশ। এরপর অনেক কাকুতি-মিনতি করে তৃতীয়বার দুপুর ১২টায় গিয়ে জিডি করতে পারি।’

তিনি বলেন, ‘শুক্রবার বেলা ১১টার দিকে খবর পাই ওসমানী হাসপাতালের মর্গে একটি বাচ্চার লাশ নিয়ে গেছে পুলিশ। সেখানে গিয়ে দেখি মাহির লাশ।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের কোনো শত্রু“ নেই। তাই আদরের ছেলেকে কেটে ময়নাতদন্ত করতে দিইনি। আবেদন করে নিয়ে এসে দাফন করি। এখন নানা গুঞ্জন শুনছি। শরীরে যে অবস্থা দেখেছি তাতে সে স্বাভাবিকভাবে মারা গেছে বলে মনে হয়নি। ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত চাই। প্রয়োজনে মামলা করব।’

এ ঘটনায় মহানগর পুলিশের কোতোয়ালি থানায় একটি অপমৃত্যু মামলা করা হয়েছে। মাহির মৃতদেহের সুরতহালকারী, মামলা ও জিডির তদন্ত কর্মকর্তা কোতোয়ালি থানার এসআই ইয়াছিন সাংবাদিকদের কে বলেন, সুরতহালের সময় মাহির শরীরে কোনো আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়নি। শুধু দু’চোখের উপরে মাছে ঠোকরানোর মতো চিহ্ন পাওয়া গেছে। তদন্তেও তেমন কিছু পাওয়া যায়নি।’

সিলেট পুলিশ সুপার মো. মনিরুজ্জামান বলেন, ‘পুলিশ লাইন পুকুরে এলাকার অনেক বাচ্চাই গোসল করতে আসে। হয়তো এ ছেলেটির সাঁতার জানা ছিল না। তাই পানিতে ডুবে মারা গেছে। তবুও বিষয়টি যথাযথ প্রক্রিয়ায় খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’

কমেন্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *