সিলেটের তামিম চৌধুরীর নেতৃত্বে যেভাবে সংগঠিত হয়েছিল নব্য জেএমবি

নিউজ ডেস্ক:: কানাডায় থাকতেই জঙ্গিবাদে জড়িয়ে সিরিয়ায় গিয়েছিল বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কানাডিয়ান নাগরিক তামিম চৌধুরী। সেখান থেকে ফের কানাডায় ফিরে যায় সে। তারপর আসে ঢাকায়, ২০১৩ সালের ৫ অক্টোবর। বাংলাদেশে এসেই তামিম প্রথমে সব জঙ্গি সংগঠনকে একই প্ল্যাটফর্মে আনার চেষ্টা করে। এসময় তার হাত ধরে ‘জুনুদ আল তাওহিদ’ নামে একটি সংগঠনের আত্মপ্রকাশ ঘটে। তবে তেমন সাড়া না পেয়ে পুরনো জেএমবি’র কয়েকজন সদস্যের সঙ্গে যোগাযোগ করে। পরবর্তীতে তামিমের নেতৃত্বেই গঠিত হয় আইএসপন্থী জঙ্গি সংগঠন নব্য জেএমবি। তামিম চৌধুরীর গ্রামের বাড়ি সিলেটের বিয়ানীবাজারে।

নব্য জেএমবি ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর থেকে টার্গেট কিলিং শুরুর ৯ মাসের মাথায় গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলা চালায়। এই হামলার মূল উদ্দেশ্যই ছিল সারাবিশ্বে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দেয়া।
বহুল আলোচিত গুলশান হামলা মামলার তদন্তে নব্য জেএমবি’র সৃষ্টি ও সংগঠিত হওয়ার এই চিত্র উঠে এসেছে। এই মামলার তৈরি হওয়া চার্জশিট এবং তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কাছ থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।

শনিবার (৩০ জুন) মামলার তদন্ত তদারক কর্মকর্তা কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট- সিটিটিসির প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘জিহাদের উদ্দেশ্য নিয়েই তামিম চৌধুরী বাংলাদেশে এসেছিল। যদিও সে কানাডায় থাকা অবস্থাতেই জঙ্গিবাদে নাম লেখায়। বাংলাদেশে তার ডাকে সারা দিয়ে পুরনো জেএমবি’র কয়েকজন সদস্য সাড়া দেয়। জেএমবি’র পুরোটা না এলেও একটা অংশ তার সঙ্গে আসে, যারা উগ্রবাদে বিশ্বাসী। তারা মিলে গঠন করে নব্য জেএমবি। এরপর সদস্য সংগ্রহের মাধ্যমে প্রথমে টার্গেট কিলিং শুরু করে তারা। পরবর্তীতে হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলা চালায়।’
এই মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, তামিম চৌধুরী ঢাকায় আসার পর প্রথমে তার পরিচয় হয় পুরনো জেএমবি’র চাঁপাইনবাবগঞ্জ এলাকার বাসিন্দা আব্দুস সামাদ ওরফে মামুর সঙ্গে। মামু তাকে পুরনো জেএমবি’র মামুনুর রশীদ রিপন, সারোয়ার জাহান ও মাওলনা আবুল কাশেমের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। এরপর ইরাক-সিরিয়াভিত্তিক আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট-আইএসপন্থী নব্য জেএমবি’র প্রথমে পাঁচ সদস্যের একটি শুরা কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটিতে তামিম চৌধুরী ছাড়াও উত্তরবঙ্গের বড় হুজুর মাওলানা আবুল কাশেম, সারোয়ার জাহান, মামুনুর রশীদ রিপন ও আব্দুস সামাদ মামু ওরফে আরিফ ছিল।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, নব্য জেএমবি’র সংগঠন পরিচালনার ক্ষেত্রে পাঁচটি পৃথক শাখা গঠন করা হয়। এগুলো হলো— সামরিক শাখা, দায়ি শাখা, মিডিয়া শাখা, কোয়াহ শাখা (অস্ত্র-বিস্ফোরক ও অর্থ) এবং পরিবহন শাখা। নব্য জেএমবি’র সামরিক শাখাটি ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এই শাখার আরও চারটি উপ-শাখা ছিল। এগুলো হলো— ফিদায়ি, ইংগিমাসি, ইশতিহাদি ও লোন উলফ বা লোন মুভার্স।

২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর থেকে নব্য জেএমবি উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জায়গায় ফিদায়ি ও ইশতিহাদি হামলা চালানো শুরু করে। ঢাকার গুলশানে হলি আর্টিজান বেকারিতে যে হামলা চালানো হয়, সেটি ছিল ইংগিমাসি হামলা। ইংগিমাসি হচ্ছে এমন একটি কৌশল, যা একই সঙ্গে জিম্মি পরিস্থিতি তৈরি করে আন্তর্জাতিকভাবে আলোচনায় আসার জন্য সর্বোচ্চ সময় নেওয়া হয়।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, বাংলাদেশে একসময় শুধুমাত্র মাদ্রাসা ছাত্রদেরই জঙ্গিবাদে জড়ানোর প্রবণতা ছিল। তামিম চৌধুরী সেই প্রবণতাকে পেছনে ফেলে উচ্চবিত্ত ও ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের জঙ্গিবাদে জড়াতে মূল ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশে আসার আগে তামিম যখন সিরিয়াতে ছিল, সেসময় সিরিয়ার বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে তার যোগাযোগ হয়। সেই যোগাযোগের ভিত্তিতেই আইএস খিলাফত ঘোষণার পর বাংলাদেশ থেকে যোগ দেওয়া তরুণদের সঙ্গেও তার পরিচয় হয়। একই পরিচয়ের সূত্র ধরে ঢাকার অভিজাত এলাকা গুলশান-বনানী এলাকার বিভিন্ন গ্রুপের সঙ্গে মেলামেশা শুরু করে তামিম। উচ্চবিত্ত পরিবার ও ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ুয়া এসব গ্রুপের সঙ্গে তার যোগাযোগের সূত্র হিসেবে কাজ করে জিলানী নামের এক তরুণ। পরবর্তীতে সিরিয়ায় আইএসের হয়ে যুদ্ধ করতে গিয়ে নিহত হয় জিলানী।

সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, হামলার জন্য হলি আর্টিজান বেকারি বেছে নেওয়ার পাশাপাশি পাঁচ হামলাকারীকে বাছাই ও নির্বাচনও করে তামিম। হামলার আগে তাদের প্রশিক্ষণের পাশাপাশি ঈমান-আক্বিদা ও শারীরিক প্রশিক্ষণের ওপর পরীক্ষাও নেওয়া হয়। নিম্নবিত্ত পরিবার থেকে জঙ্গিবাদে আসা দুই তরুণ শফিকুল ইসলাম উজ্জল ও খায়রুল ইসলাম পায়েল ও ঢাকার উচ্চবিত্ত পরিবারের তিন তরুণ রোহান, নিবরাস ও মোবাশ্বারকে নিয়ে একটি দল গঠন করা হয়। এর উদ্দেশ্য ছিল, হলি আর্টিজানে যে জিম্মি পরিস্থিতি তৈরি করা হবে তা সফলভাবে যেন সামলাতে পারে তারা।
সিটিটিসির প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেছেন, ‌‘ঢাকায় তারা কোনও একটি রেস্তোরাঁয় অ্যাটাক করবে এই পরিকল্পনা ছিল। যেখানে অনেক বিদেশি পাওয়া যাবে। তাদের মারলে বিশ্ব মিডিয়ায় কাভারেজ পাওয়া যাবে, সেই জায়গাটিকেই তারা বেছে নেবে। নব্য জেএমবি’র নেতারা এজন্য প্রথমে সদস্যদের রিক্রুট করে। ক্যাম্পে রেখে তাদের বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। দু’-একটি হত্যাকাণ্ডে অংশ নিয়ে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছে, এমন দুজনকেও এই টিমে রাখা হয়। এরকম নতুন এবং পুরনো মিলিয়ে পাঁচ জনের একটি টিম গঠন করা হয়।’
ঢাকার কাউন্টার টেরোরিজমের একজন কর্মকর্তা বলছেন, তামিম নিজেও শিক্ষিত এবং স্মার্ট হওয়ার কারণে সবাই তার কথা মনোমুগ্ধ হয়ে শুনতো। এছাড়া, দেশের বাইরে থেকে অর্থ সহযোগিতা আনতো সে। সংগঠনে পর্যাপ্ত পরিমাণ অর্থ আসার কারণে সবাই সহজেই তার নেতৃত্ব মেনে নিয়েছিল। তামিম নিজেও ছিল অনেক বেশি ক্যারিশমেটিক।
ঢাকায় একটি হামলা চালিয়ে যে সারাবিশ্বে আলোচনায় আসা যাবে, সেই ভাবনাটিও আসে তামিমের মাথা থেকে। এজন্য হামলার সঙ্গে সঙ্গে হলি আর্টিজানের ভেতরে থাকা জঙ্গিদের পাঠানো ছবিগুলো আইএসের কথিত মুখপাত্র ‘আমাক’ এজেন্সিতে পাঠিয়ে হামলার দায়ও স্বীকার করে। সিটিটিসি প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘ঢাকায় হামলা করলে কাভারেজ বেশি পাবে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে। পাশাপাশি বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের বিস্তার চরমভাবে ঘটেছে এটি প্রচার এবং নতুন যারা রিক্রুট হয়েছিল, তারাও মনোবল হারাবে না। বরং আরও দলে দলে নতুন লোক জেএমবিতে আসবে।এই পরিকল্পনা মাথায় নিয়েই কাজ করছিল তামিম।’

উল্লেখ্য, ২০১৬ সালের ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গিরা হামলা চালিয়ে ৯ ইতালিয়ান, সাত জাপানিজ, একজন ভারতীয়, একজন আমেরিকান-বাংলাদেশ দ্বৈত নাগরিক ও দুজন বাংলাদেশি এবং দুই পুলিশ কর্মকর্তাসহ মোট ২২ জনকে হত্যা করে। জঙ্গিরা রেস্টেুরেন্টের অন্যান্য অতিথি এবং কর্মচারীদের রাতভর জিম্মি করে রাখে। পরদিন সকালে সেনাবাহিনীর কমান্ডো অভিযানের মাধ্যমে শেষ হয় এই জিম্মিদশা। অপারেশন থান্ডারবোল্ট নামে পরিচালিত এই অভিযানে পাঁচ জঙ্গি ও একজন পিৎজা শেফ নিহত হয়। এছাড়া, ঘটনার সময় সন্দেহভাজন হিসেবে আটক হওয়া একজন কর্মচারী নিহত হন ৮ জুলাই। আলোচিত এই ঘটনায় গুলশান থানার পুলিশ বাদী হয়ে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে একটি মামলা দায়ের করে। আলোচিত এই হামলার মাস্টারমাইন্ড তামিম চৌধুরী ঘটনার এক মাস পরেই ২০১৬ সালের ২৭ শে সেপ্টেম্বর নারায়ণগঞ্জের পাইকপাড়ায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে দুই সহযোগীসহ নিহত হয়।
গুলশান হামলার পরই তামিমের নামটি ব্যাপক আকারে আলোচনায় আসে। তামিম সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলার দুবাগ ইউনিয়নের বড়গ্রামের প্রয়াত আব্দুল মজিদ চৌধুরীর নাতি। মজিদ চৌধুরী একাত্তরে শান্তি কমিটির সদস্য ছিলেন বলে স্থানীয়দের তথ্য।
তামিমের বাবা শফি আহমদ জাহাজে চাকরি করতেন। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে তিনি সপরিবারে কানাডায় পাড়ি জমান। কানাডার উইন্ডসরে থাকার সুবাদে ৩০ বছর বয়সী তামিমের বেড়ে ওঠাও সেখানে।

কমেন্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *